সফটওয়ার ইন্ডাস্ট্রির লাঞ্ছনা আর অনুপ্রেরণার গল্প

Shaon Majumder
4 min readApr 4, 2024

--

অবশেষে মাস্টার্স শেষ হল। মা প্রচন্ড চাপ দিত পড়াশোনায়। এখন মা নেই, তবে তার অভ্যাস রয়ে গেছে। সেটার ফলাফল স্বরূপ, নিরন্তর পড়াশোনা চালিয়ে যাবার অভ্যাসটা ধরে রেখেছি। আজ থেকে, ১০ বছর আগে, মিডিয়াম ব্লগ পোস্টে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া কেউ জিজ্ঞাসা করেছিল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিএসই পড়লে, অথবা, কারো যদি সিএসই এর সনদ না থাকে, তবে, কি কেউ পারবে নিজেকে সক্ষম করে তুলতে এই ইন্ডাস্ট্রিতে। আরেকটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই, আইইবির সনদ ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার লাগাতে পারবে। নিজের অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে, বলে উঠলাম, অবশ্যই সম্ভব। তবে সেদিন আমার যথেষ্ট প্রমাণ দেবার মত, সক্ষমতা ছিল না; আমি তখন মাত্র, রোবটিক্স চর্চাকারী, একজন ইন্টার স্টুডেন্ট ছিলাম। তাই, ১০ বছর পর, আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি — কিভাবে লাঞ্ছনাকে গ্রহণ করে, আত্মবিশ্বাসের সাথে তা সফলতায় পরিণত করা সম্ভব।

সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি আজ থেকে ১০ বছর আগে, এতটা সোজা ছিল না। অনেক লাঞ্চনা ও অহংকার চূর্ণ করে, স্থায়ী হতে হয়েছে। তার মধ্যে কিছু লাঞ্ছনা ও তার মধ্য থেকে অর্জিত শিক্ষা শেয়ার করছি আপনাদর সাথে -

অভিজ্ঞতা ১। প্রজেক্টের লিস্ট থাকার পরেও, শুনতে হল — “ তুমি ইন্টার পাস্, এখনো সেকেন্ড ইয়ারে উঠো নাই, আমরা ইন্টার্ন নেই না।” অতঃপর আরো বেশি করে প্রজেক্ট করতে থাকি। অতএব,

শিক্ষা ১ — “বেশি বেশি প্রজেক্ট করে পোর্টফলিও ভারী কর।”

অভিজ্ঞতা ২। চাকরি তো পেলাম তবে, বিজনেস ডেভেলপার হিসেবে। অতঃপর, রাতদিন পরে থেকে, প্রসন্ন করলাম ম্যানেজমেন্টকে। ডাটা এনালাইসিস স্কিল দেখাতে থাকলাম। তারপর অনুরোধ করে, মেশিন লার্নিং ইন্টার্নশিপ পেলাম। ৮ মাসে পরিসংখ্যান আর গণিতের পুরো সিলেবাস গিলে খেলাম। রাত দিন পরে থাকতে শুরু করলাম। ইন্টার্নশিপ শেষ হলে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রবেশ করলাম। লেগে থাকলে, ম্যানেজমেন্ট আপনার আন্তরিকতা দেখবেই।

শিক্ষা ২ — “লেগে থাকো আর চাইতে লজ্জা পেও না।”

অভিজ্ঞতা ৩। তুমি ইন্টার পাস্, তোমাকে বেতন দিচ্ছি স্টুডেন্ট অবস্থায় এইটাই বেশি। অতঃপর, চুপচাপ কষ্ট নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে, আরো চ্যালেঞ্জিং চাকরি নিয়েছিলাম।

শিক্ষা ৩ — “যে তোমার স্কিলের গুরুত্ব বুঝবে না, তার কাছে অপমানিত হয়ে ক্ষয় হবেন না। নিজের স্কিলটা ভালো দলনেতার আন্ডারে কাজে লাগান।”

অভিজ্ঞতা ৪। “তোমার সিএসই এর ডিগ্রি নেই, ক্লাস কর নেই, এলগড়িদম বুঝবা না। তুমি আজীবন ডেভেলপার থেকে যাবা, সলিউশন ডিজাইন করা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না। যদিও, আগের থেকে চর্চা ছিল, তারপরেও, প্রবেলম সলভিং এর চর্চা বাড়িয়ে দেই। এবং একের পর এক সিএসই স্টুডেন্ট এর থিসিস এ মেন্টরিং করে, ভালো একটা ব্যবসা দাঁড় করাই। এখন, অন্যকে নানা টপিক অফলাইনে পড়াই। আর অনলাইনে ব্লগ লিখে, বিভিন্ন কনসেপ্ট নিয়ে ব্লগ লিখে, মানুষের মন্তব্য গ্রহণ করি।

শিক্ষা ৪ — “নিজের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে, বাসায় বসেই চর্চা কর এবং অন্যকে সাহায্য কর।”

অভিজ্ঞতা ৫। “তোমার IEB সনদ নাই, নামের আগে ইঞ্জিনিয়ার লাগাতে পারবে না।” অতঃপর BCS এর সনদ নিলাম।

শিক্ষা ৫ — “সমাজের নিয়মগুলো কখনো স্বরণ করার প্রয়োজন আছে। নয়তো আরো বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হবে।”

অভিজ্ঞতা ৬। তোমাকে মৌলিক গবেষণায় রাখা মুশকিল, গণিতে আগ্রহ নাই। অতঃপর, রোবটিক্সে স্নাতক, কম্পিউটার সাইন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেবার সময়, পেপারে লেখার সময়, ফোকাস দিলাম, গণিতে।

শিক্ষা ৬ — “গণিত চর্চা করা, যেকোন সাবজেক্টে ভালো করার লাইফ টাইম ইনভেস্টমেন্ট।”

অভিজ্ঞতা ৭। কর্পোরেট আচরণবিধি, শিষ্টাচার ও রাজনীতি বুঝতে কষ্ট হত। প্রতিনিয়ত মানুষিক লাঞ্ছনার স্বীকার হবার পরেও, কলিগদের মৌখিক শান্তনা আর পরিবারের আত্মত্যাগ সদা উজ্জ্বীবিত রাখত। তাই ধৈর্য ধরে টিকে থাকা জরুরি।

শিক্ষা ৭ — রাজনীতি, আচরণবিধি আর নেগেটিভ মানুষ ইত্যাদিকে ঘৃণা না করে, কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ করতে হবে। ধৈর্যের চেয়ে বড় শক্তি নেই, যে সয়, যে ভাবে, সেইই শেষ পর্যন্ত রয়। কমিউনিকেশন স্কিল ভালো হলে, নেগেটিভ মানুষকেও, আপনি পজেটিভ কালচার তৈরিতে প্রভাবিত করতে পারবেন। তাই কমিউনিকেশন স্কিল হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিডারশিপ স্কিল। সোজা কথায় EQ ডেভেলপ করতে হবে।

অভিজ্ঞতা ৮। গলার জোরে সিস্টেম ডেভেলপ করা, নম্র পেয়ে চাপিয়ে দেওয়া, পলিটিক্স ও স্বজনপ্রীতি কেন্দ্রিক টিম থেকে ১০০ হাত দূরে থাকবেন। পলিটিক্স এর জন্য হাতের আঙুলের চেয়ে বেশি কোম্পানিকে ডুবে যেতে দেখেছি।

শিক্ষা ৮ — যে আপনাকে উপরে উঠতে দিবে, আর যাই হোক, আপনাকে কম সম্মানী অথবা জোড় পূর্বক কোন কিছু চাপাতে চাইবে না। একটি সুস্থ টিম চাইবে, আপনি নিজ থেকে এগিয়ে এসে কাজ করেন। জোড় করে, প্রডাক্টিভ টিম বানানো যায় না। আর সুস্থ টিমের বৈশিষ্ঠ হল, যে যত বেশি গ্রো করবে, নেতৃত্ব দিবে, তাকে তত সম্মানী দিতে হবে। সবসময় নিজেদের টিমের মধ্যে একসাথে কাজ করা এবং প্রতিযোগিতা, উভয়ের সম্বনয় থাকতে হবে। ম্যানেজমেন্ট কে এসে , অবশ্যই মুখবাণী এবং উপস্থিত থেকে, ডেভেলপারদের পুরস্কৃত করতে হবে। মোটিভেশনই একটি দ্রুতগামী কোম্পনির বাহক।

অভিজ্ঞতা ৯। আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান যেকোন ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার চাবিকাঠি। তাই বিনয়ী হবার সাথে সাথে আত্মবিশ্বাসী না হলে, উপযুক্ত নেতৃত্ব প্রদান অসম্ভব।

শিক্ষা ৯ — কে আপনার গঠনমূলক সমালোচনা করছে, আর কে আপনাকে দুর্বল অনুভব করানোর চেষ্টা করছে, দুটোর মধ্যে পার্থক্য করা জানতে হবে। উপদেশ আর অপমান এর মধ্যে সূক্ষ্ম তফাৎ চিনতে শিখুন। কে আপনার অগ্রগতিতে হিংসুক, তাদের কে আগে চিহ্নিত করে, সাবধান হন।

আরো পথ অতিক্রম করতে হবে, সাথে পাব আরো অভিজ্ঞতা। আমরা, সবাই চেষ্টা করব, আমাদের প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাগুলো, নতুন প্রজন্মদের হাতে ছড়িয়ে দেবার।

--

--

Shaon Majumder
Shaon Majumder

Written by Shaon Majumder

Software Engineer | Author | Data Scientist

No responses yet